বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে হয়েছে সমস্যা।
বাবা মা এতোদিন তিন মাস করে চার ছেলেমেয়ের বাসায় থাকতেন সারা বছর ধরে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে হয়েছে সমস্যা। মা কিছুতেই আর আগের মতো বছরে চারবার বাড়ি বদলাতে রাজি না। আমি আর অহনা কানাডায় কিন্তু টিংকু আর পিন্টু দুই ভাই আমেরিকায়। একজন মিশিগান তো অন্যজন ফ্লোরিডা।
বাবা মা উপভোগ করতেন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন টাইম জোনের পার্থক্য, আবহাওয়ার পরিবর্তন। কানাডায় যখন প্রচন্ড শীত তখন ওঁদের ফ্লোরিডায় পাঠানো হতো। আবার কানাডায় উ'ষ্ণতার পরশ নিতে এদিকে আসতেন। ছোটো মেয়ে অহনার প্রতি তাঁদের আলাদা টান ! ফ্লোরিডা থেকে সরাসরি মিশিগান না এসে ক্যালগেরি আসতেন আগে। তিনমাস পর আমার কাছে টরন্টোতে পুরো গ্রীষ্মকাল কাটিয়ে তারপর মিশিগান টিংকুর কাছে।
মা বলছেন, "তোরা আমাকে আর এত টানা হ্যাচড়া করিস না। তোদের বাবা থাকতে ঘুরতাম। সে পছন্দ করত। সব ছেলেমেয়ের কাছে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগত। লোকটা আমাকে ফাঁকি দিয়ে আগেই কেটে পড়ল। আর পারব না বছরভর ঘুরে বেড়াতে।”
টিংকুর ওখানে মিশিগানে থাকা অবস্থায় বাবা হঠাৎ একদিন চলে গেলেন ঘুমের মাঝে। আমরা সবাই খবর পেয়েই এসেছি। এখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছে বাবাকে।
এক সপ্তাহ কাটালাম মায়ের সাথে। সবার কাজকর্ম আছে। কত আর থাকা যায়? কয়েক রাত মায়ের সাথে ছিলাম এক বিছানায়। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। ক’দিনেই অনেকটা বুড়িয়ে গেছেন। একাকিত্ব আর বিচ্ছেদের অনুভূতি একবার পেয়ে বসলে তা থেকে বের হয়ে আসা কঠিন।
চুপচাপ সারাদিন কোরান শরীফ আর নফল নামাজ পড়েন।
রাতে পাশে শুয়ে বললাম, আমার সাথে যাবে, মা?
এখানেই থাকি কটা দিন। তোর বাবা তো এখান থকেই চলে গেল। বিছানায়, বালিশে এখনও গায়ের গ'ন্ধ পাই।
তোমার গরম লাগছে না? মাফলার কেন পরে আছ ?
এই মাফলারটা তোর বাবা ২৪ ঘন্টা পরে থাকত। গলায় সামান্য কাশি ছিল। মনে আছে, বুনেছিলাম সেই কবে ? ৩০ বছর আগের কথা। বলতাম অন্যটা পরো। এটাই নাকি তার ভালো লাগে। রঙ চটে পুরোনো হয়ে গেছে।
মায়ের মধ্যে অতীত, বর্তমানের বিশাল সংকট চলছে। ৭৫ বছর বয়সে চা'হি'দাগুলো ক্ষী'ণ হতে হতে একেবারে বুঝি মিলিয়ে যায়। জীবনের চাওয়া পাওয়াগুলিকে খুব মামুলি মনে হয়। স্মৃতিগুলি ফিকে হতে থাকে, কিছু স্মৃতি খুব স্পষ্ট মনেও পড়ে। কয়েকদিন সঙ্গে থেকে খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করলাম মা যেন এক ঘোরের মাঝে বাস করছেন।
বাবাকে ডাকছেন প্রায়ই,
টিংকুর বাবা তুমি গরম পানি খাও তো ! কী যে খুক খুক কাশি হয়েছে !
গায়ে হাত রেখে বলি, 'মা কি বলছো?'
তোর বাবার কাশি। ঘুমের মধ্যেও কাশে। গারগল করতে বলি, করে না।
মা, ঘুমাও তো ! বাবা ঘুমাচ্ছে।
তোর বাবা চিরদিনের জন্য ঘুমাতে চলে গেছে। বলেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করল মা।
আমি পিছন থকে জাপটে ধরলাম।
পরদিন চার ভাই বোনের বৈঠক হলো মাকে নিয়ে। মায়ের এক দাবী, ছেলেমেয়েরা নিজেরা ভেবে ঠিক ক'রুক কী করবে। কিন্তু, উনি বছরে চারবার ব্যাগ নিয়ে ঘুরতে রাজী নন দুই দেশের মধ্যে। নতুবা তাঁকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হোক।
আমিঃ এখন তো মা নড়তে চাইছে না কোথাও। আমি সামনের মাসে এসে নিয়ে যাব। তোদের আপত্তি না থাকলে আমার কাছেই থাকুক।
অহনাঃ আপু, তোমার কাছে কী করে থাকবে সারা বছর ? তুমি বিজনেস ট্রি'পে থাকো মাসের অর্ধেক। দুলাভাই ম্যানেজ করতে পারবে না।
কী করা যাবে? মায়ের জন্য আলাদা লোক রাখব।
টিংকুঃ ছোটো আপু, তোর তো সপ্তাহে তিনদিন ওয়র্ক ফ্রম হোম। তুই নিয়ে যা মাকে।
অহনাঃ ওঃ, বাবা নাই দেখে এখন মা বোনেদের হয়ে গেল ? তোরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরবি ? তোর বউ তো বাসায় হোম ডে কেয়ার চালায়। এখানে থাকলেই তো পারে।
পিন্টুঃ মা আমার সাথেই থাকুক কিছুদিন ফ্লোরিডাতে। ওয়েদারও ভালো। আমি, জলি আর নাহিয়ান মিলে মায়ের যত্ন করতে পারব।
অহনাঃ জলি করবে মায়ের য'ত্ন? তাহলেই হয়েছে? যখন ফ্লোরিডায় ছিলাম দেখেছি না ! মায়ের নিয়মিত কলা, দুধ খেয়ে অভ্যাস। জলি ইচ্ছে করে আনত না।
আমি আর কী বলব ! বুঝলাম, টিংকু আর অহনা দু’জনেই এর ওর উপর চাপাতে চাইছে মাকে।
আমাদের এই আলোচনার মাঝে ভাইয়ের বৌ আর দুই জামাই অনুপস্থিত ছিল ইচ্ছে করেই। অহনা পিন্টুর বউয়ের নাম নিতেই জলি কোত্থেকে উড়ে যেন চলে এল।
ছোটো আপু, কখনো কিছু বলি না দেখে ভেবো না আমার মুখ নাই। আমি মাকে অবহেলা করেছি আর তুমি কী করতে যখন আমরা নিউইয়র্কে থাকতাম ? একই রাস্তায় থাকা সত্ত্বেও প্রতি উইকেন্ডে তোমার ঝামেলা থাকত। বাবা মা সারা সপ্তাহ আমাদের সঙ্গে থাকার পর শুক্রবার বিকেলে তৈরি হয়ে বসে থাকতেন। তোমার কোনো পাত্তাই পাওয়া যেত না। মা অস্থির হতেন বলে পিন্টু নিজেই নিয়ে যেত তাঁদের। তুমি তাঁদেরকে বাসায় রেখে পার্টি করতে যেতে। বললেই তো বলবে আমি খারাপ, বেয়াদব। কিন্তু ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট!
অহনা তেলেবেগুনে জ্ব'লে উঠল। বুঝতে পারছিলাম বিশাল এক ঝগড়া শুরু হতে যাচ্ছে। মাত্র বাবাকে হারিয়েছি...ঠিক এই সময় পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া ছাড়া কোনো বিকল্প কি নেই?
দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললাম," দশ/ বারো বছর আগের কথা নিয়ে ঝগড়া, মনোমালিন্য করা কি ঠিক? তোমাদের দু’জনেরই বয়স কম ছিল। না বুঝে অনেক কিছুই করেছ হয়তো। দু'একদিনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা অসন্তুষ্টি মনে পুষে রাখা মানে নিজেকেই ক'ষ্ট দেয়া। মায়ের বাসস্থান সমস্যা নিয়েই কথা বলি, অন্য কিছু মূলতবী থাকুক।
জলিঃ বড়পা, তোমাকে অনেক শ্রদ্ধা করি, তুমি জানো। এই পরিবারের একজনও তোমার মতো নয়। মায়ের জন্য ইচ্ছে করে কলা কিনিনি তা না, মানুষের কি ভুল হয় না? এতোদিন পর ছোটোপু সেই খোঁটা দিলো, তুমি যে এত করো বড়পা সবার জন্য, তারপরও এরা সবাই বসে তোমার নিন্দা করে। কারণ কি জানো? হিং*সা ! তুমি এত ভালো জব করো, সারা দুনিয়া ঘুরছ চরকির মতো। দুলাভাই তোমাকে কিছু বলে না। সেজন্য তোমার আপন বোন, ভাইরা হিং*সা করে।
আমি জলির হাত ধরলাম। মেয়েটা আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কেঁ'দে ফেলেছে। এই মেয়েটা নিরপেক্ষভাবে পুরো পরিবারকে মূল্যায়ন করতে শিখল কবে ?
পরিবারের প্রত্যেককে আমি আমার পাঁচ আঙ্গুলের মতো চিনি। প্রত্যেকের মনোভাব, প্রতিটি পদক্ষেপ বলে দিতে পারি। সেই অনুযায়ী ডিপ্লোম্যাসি করে চলি। পলিসি বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞ আমি। বিপরীত পক্ষের মনোভাব আঁচ করতে পারি নির্ভুল।
জলি ঠিক কথাই বলেছে। অহনা একটু অমনই। আমার বোন বলে যে অন্যরকম হবে তা সত্যি না। অহনা বাবা মায়ের আদর বেশি পেয়েছে, চেঁ'চা'মে'চি করে আদর, খেলনাপাতি আদায় করতে ওস্তাদ ছিল। এখনও তাই আছে। খেলনার বদলে চাহিদা এখন গিফট কার্ড, দামী শাড়ি। ঈদ, জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকীতে যে যত দূরেই থাকি না কেন, অহনার মেজাজ খারাপ হবার আগেই উপহার পাঠাতে কেউ ভুলি না। আমি, পিন্টু, টিংকু ছোটোবেলা থেকে এই নিয়ম দেখে আসছি। আমাদের কাছে যা খুব স্বাভাবিক তা জলির কাছে অস্বাভাবিক। আমাকে যে ভাইবোনেরা হিংসে করে তা আমি খুব গভীরভাবে টের পাই। সবার চাইতে মেধায়, বুদ্ধিতে, অর্থে আমি এগিয়ে আছি।